জন্ম:১৮৯৭, মৃত্যু: ১৯৫৯
তুলসী লাহিড়ী রংপুর (বর্তমান
গাইবান্ধা) জেলার সাদুল্লাপুর
উপজেলার নলডাঙ্গায় জমিদার
পরিবারে ১৮৯৭ সালে জন্মগ্রহণ
করেন। তাঁর পিতার নাম সুরেন্দ্র
চন্দ্র লাহিড়ী এবং মাতার নাম
শৈলবালা দেবী। তুলসী লাহিড়ীর
পিতৃদত্ত নাম হেমেন্দ্র চন্দ্র
লাহিড়ী। স্কুলে ছাত্রাবস্থায়
বড়লাট লর্ড কার্জনের সময়ে ১৯০৫
সালে হয় বঙ্গভঙ্গ। বঙ্গভঙ্গের
কারণে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন
তখন তুঙ্গে। আর দশজন স্কুল
পড়ুয়া বন্ধুর সাথে
মিলে তিনি পুলিশের
নজরে বড়লাট ‌‘কার্জন বিরোধী’
আন্দোলনে সামিল হন।
তিনি পুলিশের নজরে পড়েন। তাঁর
নামে জারি হয়
গ্রেফতারী পরোয়ানা। ভীত
সন্ত্রস্ত পিতা সুরেনন্দ্র চন্দ্র
লাহিড়ী উপায়ন্তর
না দেখে কোচবিহারে তাঁর
পিতৃদেবের করদমিত্র রাজ্য হওয়ায়
ব্রিটিশ শাসনের বাইরে ছিল।
গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হওয়ার
কারণে নলডাঙ্গার স্কুল কর্তৃপক্ষ
‘রাজটিকেট’সহ হেমেনকে স্কুল
থেকে যথারীতি বহিস্কার করেন।
হেমেনের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ
করেন এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
কোচবিহারে সে সময় কলেজ
প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
কাছেকূলে বিহার প্রদেশ। কিন্তু
তা ব্রিটিশ শাসনাধীনে। সাব্যস্ত
হলো, এফিডেভিটের মাধ্যমে নাম
পরিবর্তন। হেমেন্দ্র চন্দ্র
লাহিড়ী রাতারাতি বনে গেলেন
তুলসীদাস লাহিড়ীতে। বিহার
থেকে বি.এ পাশ
করে তিনি চলে আসেন কলকাতায়।
কলকাতা আইন কলেজ থেকে বি.এল
পাশ করন। সে সময়ে রংপুরের
মোহাম্মদ ওয়ায়েস, বদিরউদ্দিন
আহমদ প্রমুখ ছিলেন তাঁর সহপাঠী।
রংপুরে আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন
শুরু করেন তিনি। ঐতিহ্যবাহী নাট
সংগঠন রঙ্গপুর নাট্যসমাজের
সাথে তিনি যুক্ত হন। রঙ্গপুর
নাট্যসমাজ
রঙ্গমঞ্চে নাটকাভিনয়ে হয় তাঁর
হাতেখড়ি।
তুলসী লাহিড়ী অভিনীত প্রথম
নাটক ‌‘কর্ণার্জুন’। ‘মিশরকুমারী’,
‘কিন্নরী’, ‘ব্যাপিকা বিদায়’
প্রভৃতি নাটকে তিনি অভিনয়
করেছেন। রঙ্গপুর নাট্যসমাজ
রঙ্গমঞ্চে সাফল্যের সাথে মঞ্চস্থ
হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিরকুমার
সভা’। এ নাটকে অক্ষয়ের ভূমিকায়
প্রবোধ মুখার্জী এবং রসিকের
ভূমিকায় অীভনয় করেন
তুলসী লাহিড়ী।
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রপাধ্যয়ের
‘দত্তা’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দান
করেন প্রবোধ মুখার্জী। নাটকের
নাম ‘বিজয়া’। তুলসী লাহিড়ী এ
নাটকেও অভিনয় করেছেন।
পিতার কাছে সঙ্গীতচর্চায় হয় তাঁর
হাতেখড়ি।
রংপুরে নানা অনুষ্ঠানে সঙ্গীতের
ব্যবস্থা করতেন পিতা সুরেন্দ্র চন্দ্র
লাহিড়ী। রংপুর ইন্সটিটিউট ক্লাব
নানা ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন
করতো। তুলসী লাহিড়ী ও তাঁর
বন্ধুবান্ধবদের সহযোগিতায় সেসব
অনুষ্ঠান হতো প্রাণবস্ত। ‘রঙ্গপুর
সারস্বত সম্মেলন’ আরেক বিখ্যাত
প্রতিষ্ঠান। সারস্বত সম্মেলন
ভবনেও আয়োজিত হতো বিভিন্ন
উপলক্ষ্যে নানা অনুষ্ঠান। রংপুর
ইন্সটিটিউট ক্লাবের সদস্য ছিলেন
লাহিড়ী। ক্লাবের পক্ষ
থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের
আয়োজন
করা হলে তিনি কলকাতা থেকে গায়ক
ও বাদক দলকে নিয়ে আসার
ব্যবস্থা করতেন।
দোলপূর্ণিমায় উৎসব হতো।
তুলসী লাহিড়ী, তাঁর সংগীতরসিক
ভাইরা ও অন্যান্য বন্ধুবান্ধব আবির
মেখে অভিনব সাজে সজ্জিত হতেন।
এরপর তাঁরা লরিতে চেপে সভ্যদের
বাড়ীতে যেতেন। তাদেঁর
কাছে চাঁদা আদায় করতেন।
বিকেলে অনুষ্ঠিত হতো ভোজসভা।
সেই অনুষ্ঠানে তুলসী লাহিড়ীর
অনুজ গোপাল লাহিড়ী ক্লারিওনেট,
শ্যামাদাস লাহিড়ী এসরাজ
এবং স্বয়ং তুলসী লাহিড়ী বাজাতেন
জলতরঙ্গ।
রংপুরে থাকাকলে তুলসী লাহিড়ীর
বন্ধুবান্ধব ও অনুরাগীদের
বাড়ীতে মাঝে মাঝে অনুষ্ঠিত
হতো গানের আসর। মধ্যরাত পর্যন্ত
গোপাল লাহিড়ী এধরণের
অনুষ্ঠানে বাঁশীতে বাজাতেন
দরবারী কানাডা।
বাংলা নাট্যসাহিত্যে তুলসী লাহিড়ীর
আর্বিভাবের পটভূমি পর্যালোচনায়
দেখা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯
সাল) থেকে দেশভাগের
মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার
(১৯৪৭ সাল) পূর্বক পর্যন্ত এদেশের
বুকের ওপর দিয়ে তড়িৎ প্রবাহের
ন্যা কতগুলো বিশেষ বিশেষ
ঘটনা সংঘটিত হয়। যেমন
সর্বগ্রাসী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
(১৯৩৯-১৯৪৫), ১৩৫০ বঙ্গাব্দের (১৯৪৩
সাল) মহামন্বন্তর ও শেষে দেশ
বিভাগ ঘটনায় সামাজিক
জীবনে সৃষ্টি হয় প্রবল প্রতিক্রিয়া।
১৯৩৯ সাল থেকে শুরু করে ১৯৪৭
সালে দেশ বিভাগের
পরবর্তীকালে ঘটনাবলী অবলম্বনে তুলসী লাহিড়ী রচনা করেছেন
তাঁর নাটকসমূহ।
রঙ্গপুরের গ্রামীণ কাহিনী,
জনজীবনের দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও
বহুবিধ সমস্যা বাস্তব সত্যের
স্পর্শে জীবন্ত
হয়ে ফুটে উঠেছে তাঁর নাকটগুলোত।
রঙ্গপুরের লোকমুখের ভাষায়
‘ছেঁড়াতার’ ও ‘দু:খীর ইমান’ নাটক
দুটি রচনা করে তিনি অসামন্য
খ্যাতির অধিকারী হয়েছেন।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমিকায়
রঙ্গপুর জেলার গ্রাম্য
কৃষকসমাজকে ভিত্তি করে তিনি রচনা করেছেন
‘ছেঁড়াতার’ নাকট। এই
সমাজে একটি বিশেষ পরিবারের
দু:খ বেদনার কাহিনী ‘ছেঁড়াতার’
নাটকের মুখ্য বর্ণনীয় বিষয়। তাঁর
‘দু:খীর ইমান’ নাটকটিও রচিত
হয়েছে পঞ্চাশের মহান্বস্তরের
পটভূমিকায়। ‘ছেঁড়াতার’ ও ‘দু:খীর
ইমান’ নাটক দুটিতে গ্রামীণ
পরিবেশের সাধারণ মানুষের সুখ-
দু:খ, আশা-আকাঙ্খার চিত্রাঙ্কন
সার্থক হয়েছে। বহুরূপী সম্প্রদায়
অভিনীত ‘ছেঁড়াতার’ নাটক
কলকাতার রঙ্গমঞ্চে বিশেষ
সংবর্ধিত হয়েছিল।
তুলসী লাহিড়ী রচিত ‘পথিক’ (১৩৫৮)
নাটকে বর্ণিত ঘটনাধারা এরূপ
‘কালের যাত্রা চলেছে অব্যাহত
বেগে। সেই যাত্রাপথের পরিবর্তন
হয়, পরিবর্তন হয় পথিকেরও।
আজিকার সংশয় ও সংঘাত জড়িত
পথে যে নতুন পথিকের চলা শুরু
হয়েছে তার
পদে পদে বাধা উপলখন্ড,
বাঁকে বাঁকে অনিবার্য সংগ্রামের
অশান্ত বিক্ষোভ। শ্রেণীতে আর
মিলিত শান্তি নাই, এক শ্রেণীর
সঙ্গে অপর শ্রেণীর নিদারুণ দ্বন্দ্ব
কোলাহল নিশ্চিন্ত শান্তির
পরিবেশ আজ নিষ্ঠুরভাবে পীড়িত।‘
বর্তমান জীবনের তিক্ত অথচ একান্ত
সত্য দিকটি প্রকাশিত হয়েছে এ
নাটকটিতে। ‘লক্ষ্মীপ্রিয়ার
সংসার’ নাটকে দারিদ্র্য ও
বঞ্চনা মানুষের
জীবনকে কী শোচনীয়
স্তরে টেনে আনে তাঁর মর্মান্তিক
চিত্র রূপায়িত হয়েছে।
তুলসী লাহিড়ী বিরচিত সর্বশেষ
নাটক ‘ক্ষণিকের অতিথি’। অন্যান্য
অনেক নাটকের ন্যায় ‘ক্ষণিকের
অতিথি’ও মঞ্চ সফল দর্শক নন্দিত
নাটক।
সমালোচক অজিত কুমার ঘোষ
বলেন- ‘তিনি (তুলসী লাহিড়ী)
সমাজ ব্যবস্থার গলদ সন্ধান
করিয়াছেন ইহার প্রতিকারেরও
ইঙ্গিত মাঝে মাঝে দিয়াছেন
কিন্তু নাটকের প্রয়োজনের
কাছে তাঁহার সমাজতত্ত্বের
প্রয়োজন বড় হইয়া উঠে নাই। সেজন্য
তাঁহার নাটকে আমরা নাট্যজীবনই
দেখিতে পাই, তত্ত্বজীবন নহে।‘
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়
(১৯৩৯-১৯৪৫ খ্রি:)
বাংলা নাট্যসাহিত্যের নবধারার
সৃজনকাল। একালের
তুলসী লাহিড়ী পালন করেছেন
পথিকৃৎ-এর ভূমিকা। সমাজ জীবনের
নানাবিধ সমস্যা, জীবন সংগ্রামের
অভাব, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির
মর্মান্তিক অস্তিত্ব, নীতির
অবক্ষয় এবং জাতীয় জীবনের
সর্বক্ষেত্রে নেমে আসা ধ্বসের
চেহারা তুলসী লাহিড়ীর
নাটকে জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়।
সমসাময়িক নাট্যকারদের
মধ্যে বিজন ভট্টাচার্য (১৯১৭-১৯৭৮
খ্রি:) দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায় ও
সলিল সেনের
নামা আমরা বরতে পারি।
বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালের ভয়াবহ সমাজ
সমস্যার রূপকল্প নির্মাণে এসব
নাট্যকারদের ভূমিকা অত্যন্ত
প্রশংসনীয়। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত
সমাজে বেকার সমস্যার তীব্রতা,
গুপ্ত সন্ত্রাসবাদ, ইংরেজদের
অত্যাচার, দেশ বিভাগ, উদ্বান্তু
সমস্যা এবং চরিত্র ভ্রষ্টতার প্রকট
নমুনা তুলে ধরতে নাট্যকারের
জুড়ি ছিল না।
তুলসী লাহিড়ীর শিল্পীসত্তার
আরেক বৈশিষ্ট্য সঙ্গীত রচয়িতা ও
সুরকার হিসেবে। কলকাতায়
বঙ্গবাসী কলেজে ছাত্রাবস্থার
সঙ্গীতচর্চায় তিনি আত্মনিয়োগ
করেন। প্রখ্যাত গায়ক কানাকৃষ্টের
কাছে এ সময়ে তিনি গান শেখেন।
এরপর তিনি লক্ষ্মৌতে চলে যান।
গায়ক অতুলপ্রসাদ সেসময়ে ছিলেন
লক্ষ্মৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের
উপাচার্য। তিনি তুলসী লাহিড়ীর
গান শেখার ব্যবস্থা করেন।
‘রামপুরী ঘরানা’ খ্যাত ওস্তাদ
সালামত আলী খানের
সান্নিধ্যে তিনি আসেন। তাঁর কাছ
থেকে উচ্চাঙ্গসংগীতের পাঠ
তিনি গ্রহণ করেন।
লক্ষ্মৌ থেকে পুনরায়
তিনি চলে আসেন কলকাতায়।
চলচ্চিত্রের সাথে তিনি যুক্ত হন।
‌হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ ও ‘মেগাফোন
কোম্পানীতে’ কাজী নজরুল
ইসলামের
সাথে সঙ্গীতে তিনি কণ্ঠ
মিলিয়েছেন। তুলসী লাহিড়ীর
সংস্পর্শে এসে বিগত শতাব্দীর
ত্রিশ-চল্লিশ
দশকে সঙ্গীতশিল্পী কমলা ঝরিয়া (১৯০৬-১৯৭১)
খ্যাতির অধিকারী হয়েছেন।
কলকাতার নাট্যমঞ্চেরও
তিনি একজন সফল অভিনয়
শিল্পী স্টার থিয়েটারের
সাথে যোগাযোগ তাঁর জীবনে সুফল
বয়ে আনে। অহীন্দ্র চৌধুরী, অপরেশ
মুখোপাধ্যায়, দুর্গাদাস
বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর গাঙ্গুলী,
দানী বাবু প্রমুখের
সংশ্রবে তিনি আসেন।
তুলসী লাহিড়ী নির্বাক যুগের
চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।
পরিচালক হীরেন্দ্রনাথ বসু
(১৯০২-১৯৮৭) তাঁর নির্বাক ছবি ‘চুপ’-
এ অভিনয় করার জন্য সর্বপ্রথম
তুলসী লাহিড়ীকে এনেছিলেন
চলচ্চিত্রের পর্দায়। হাস্যরসাত্মাক
অভিনয়ে তুলসী লাহিড়ী ছিলেন
অনন্য। ‘যমুনা পুলিনে’ ছায়াছবির
চিত্রকাহিনী ও গান
তিনি রচনা করেছেন। ‘মনিকাঞ্চন’
ছায়াছবিতে তিনি প্রথম অভিনয়
করেন। ‘রিক্তা’


তিনি অভিনয় করেছন। ‘মনিকাঞ্চন’
ও ‘রিক্তা’ ছায়াছবির চিত্রনাট্য
তিনি রচনা করেছেন। জানা যায়,
পঞ্চশটিরও
বেশি ছায়াছবিতে তিনি অভিনয়
করেছেন। বহুমাত্রিক
শিল্পপ্রতিভার অধিকারী ছিলেন
তুলসী লাহিড়ী। তিনি ছিলেন মঞ্চ
অভিনেতা, চিত্রাভিনেতা,
নাট্যকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক,
চিত্র নাট্যকার ও চিত্র পরিচালক।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনের যুগনায়ক
তুলসী লাহিড়ী ১৯৫৯ সালের
২২শে জুন কলকাতারয় পরলোকগমন
করেন।

image

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s