গাইবান্ধার নামকরণের ইতিহাস
গাইবান্ধা নামকরণ প্রসংগঃজেলা শহরের
বর্তমান অবস্থানের গাইবান্ধা নামকরণ
ঠিক কবে নাগান হয়েছে তার সঠিক তথ্য
এখনও পাওয়া যায় নি। তবে রংপূরের
কালেকক্টর ইজি, গ্লেজিয়ার ১৮৭৩
সালে যে রিপোর্ট প্রণয়ন করেছিলেন সেই
রিপোর্ট
গাইবান্ধা নামটি ইংরাজীতে লেখা
হয়েছে এণঊইঅঘউঅ এবং সেই এণঊইঅঘউঅ
এর অবস্থান হিসেউেল্লেখ
করা হয়েছে ঘাঘট পাড়ের কথা। এই ঘাটটই
যে ঘাঘট নদী সেটা বলা যায়। রংপুরের
গ্লেজিয়ার সাহেবের পূর্বে কালেকটর
ছিলেন জেমস রেনেল। তার প্রণীত রেনেল
জার্নালস থেকে জানা যায় ১৭৯৩
সালে উত্তর বঙ্গে পুনভাব, ধরলা, তিস্তা,
মানস এবং ঘাঘট খাল
নৌ পরিবহনে সহায়ক ছিল।
লেখা হয়েছে ঘাঘট
খালে জানুয়ারী মাসেই বিরাট বিরাট
নৌকা চলাচল করতো। জেমস রেনেল
এবং ইজি গ্লেজিয়ার দুজন কালেক্টরের
রিপোর্টেই অবশ্য ঘাঘটকে খাল
হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেদিক
থেকে বোঝা যায় ঘাঘট নদী ১৭৯৩ সালেও
সে সময়ের নদী গুলোর চাইতে ছোট
আকৃতির ছিল বলেই ঘাঘটকে খাল
হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার এই
তথ্য থেকে আরেকটা বিষয় বলা যায় যে,
১৭৯৩ সালেও মানস নদী ছিল। ঘাঘট নদীর
মতই। অপর যে বিষয়টি এই দুটি তথ্য
থেকে অবহিত হওয়া যায়, তা ১৭৯৩
সালে গাইবান্ধা নামটি উল্লেখযোগ্য
ছিল না। ১৮৭৩ সালে ইজি গ্লেজিয়ার তার
রিপোর্টে গাইবান্ধা নামটি উল্লেখ করেন
। সম্ভবতঃ ১৭৯৩ সালের আগে ঘাঘট নদীর
তীরবতী এই স্থানটি একটি পতিত ভূখভ
এবং গোচারণ ভূমি হিসাবে ব্যবহৃত হতো।
জনবসতি ছিল না বলেই রংপুরের
কালেক্টদের
রিপোর্টে গাইবান্ধা নামটি ১৮৭৩ সালের
আগে উল্লিখিত হয়নি। গাইবান্ধার
নামকরণ সম্পর্কে দুটি কিংবদন্তী প্রচলিত
আছো একঢি কিংবদন্তীতে বলা হয়েছে,
পাচ হাজার বছর আগে মৎস্য দেশের
রাজা বিরাটের রাজধানী ছিল
গাইবান্ধার গোবিন্দগজ থানা এলাকায়।
মহাভারতের কাহীনি বলা হয়েছে এই
রাজা বিরাটের রাজসভায় পঞ্চ পান্ডবের
দ্রৌপদীসহ ছদ্মবেশে তদের ১২ বছর
নির্বাসনের পরবতী ১ বছর অজ্ঞাত বাস
করেছে। অজ্ঞাত বাসকালে যুধিষ্টির কঙক
নামে বিরাট রাজর পাশা খেলার
সাথী হয়েছিলেন। আর ভীমের দায়িত্ব
ছিল পাচকের কাজ করা এবং তার ছদ্মনাম
ছিল বল্লভ। বিরাট রাজার
মেয়ে রাজকন্যা। উত্তমার নাচ, গান ও
বাদ্যযন্ত্র শিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিলেন
অর্জুন বৃহন্নলা ছদ্মনামে। গোশালার
দায়িত্বে ছিলেন সহদেব তন্তীপাল
নামে এবং অশ্বশালার দায়িত্বে ছিলেন
নকূল, তার ছন্দনাম ছিল গ্রন্থিক। আর
বিরাট রাজার রানী সুদেষ্ণার
গৃহপরিচারিকা হয়েছিলেন
সৌরিনদ্রী নামে রৌপদী।
বলা হয়ে থাকে এই বিরাট রাজার গো-
ধনের কোন তুলনা ছিল না। তার গাভীর
সংখ্যা ছিল ষাট হাজার।
মাঝে মাঝে ডাকাতরা এসে বিরাট
রাজার গাভী লুণ্ঠন করে নিয়ে যেতো।
সে জন্য বিরাট রাজা একটি বিশাল পতিত
প্রান্তরে গো-শালা স্থাপন করেন। গো-
শালাটি সুরক্ষিত এবং গাভীর খাদ্য ও
পানির সংস্থান নিশ্চিত করতে।
নদী তীরবর্তী ঘেসো জমিতে স্থাপন
করা হয়। সেই নির্দিষ্ট
স্থানে গাভীগুলোকে বেঁধে রাখা হতো।
প্রচলিত কিংবদন্তী অনুসারে এই
গাভী বেঁধে রাখার স্থান
থেকে এতদঞ্চলের কথ্য
ভাষা অনুসারে এলাকার নাম
হয়েছে গাইবাঁধা এবং কালক্রমে তা
গাইবান্ধা নামে পরিচিতি লাভ করে।
গাইবান্ধা নামকরন সম্পর্কে ভিন্ন মতও
রয়েছে। কারণ গাইবান্ধা জেলার
সাথে রাজা বিরাটের সম্পর্ক
ঐতিহাসিকভাবে আজও প্রমাণিত হয়নি।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন
স্থান যেমন হাতীবান্ধা, বগবান্ধা,
চেংড়াবান্ধা,
মহিষবান্ধা ইত্যাদি নামে জায়গা থাকায়
মনে হয় গাইবান্ধা নামটি খুব
বেশী পুরানো নয়। রাজা বিরাটের
সাথে সম্পর্ক থাক বা না থাক
গাইবান্ধা নামটি যে গাভীর প্রাচুর্য
এবং গাভী বেঁধে রাখার ব্যাপার
থেকে এসেছে সে কথা ধারণা করা যায়।
তবে মহাভারতের সেই রাজা বিরাট
যে গাইবান্ধার রাজা বিরাট তার পক্ষেও
উল্লেখযোগ্য কিছু যুক্তি রয়েছে। এ
প্রসংগে মনূসংহিতার সংস্কৃত
শ্লোকে বলা হয়েছে (মনূ ৭/১৯০)।
‘‘কুরুক্ষেত্রাংসচ মৎস্যাংসচ পঞ্চামান,
শুরেসেন জান দীর্ঘণ লঘূংশ্চৈব নরামু
গ্রীনীকেষু যোধয়েৎ’’ এই
শ্লোগানটিতে বলা হয়েছে যে মৎস্যাদি
দেশের লোকেরাই
রণক্ষেত্রে অগ্রগামী হয়ে যুদ্ধ করত।
মহাভারতের বিরাট পর্বে যে মৎপীদেশের
কথা বলা হয়েছে এবং বিশ্ব কোষের
অষ্টাদশ ভাগের ৬৯০ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত
মনুরবচন
অনুসারে রাজা বিরাটকে মৎস্যদেশ
অর্থাৎ মাছ প্রধাণ এবং নদীমাতৃক দেশ
হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেদিক
থেকে এই উপমহাদেশের নদীমাতৃক
এবং মাছ প্রধান
এলাকা বলতে বাংলাদেশের এই অঞ্চলকেই
বুঝায়। নরেন্দ্রবসু প্রণীত বিশ্ব কোষের
অষ্টাদশ খন্ডে রাজা বিরাট
সম্পর্কে উল্লেখ আছে যে ‘‘ঁবরেন্দ্র খন্ডের
মধ্যবতী উক্ত বিরাট নামক প্রাচীন জনপদ
গাইবান্ধার অন্তর্গত গোবিন্দগজ থানার
করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে ৬ মাইল
দুরে অবস্থিত। উক্ত বিরাট ঘোড়াঘাটের
আলীগাও পরগণার অন্তর্গত। খৃষ্টীয় দশম
শতাব্দীতে ঢাকা নগরিতে বাংলার
রাজধানী স্থাপিত হলে ঘোড়াঘাটের
প্রশাসনিক গুরুত্ব কমতে থাকে এবং সমৃদ্ধ
জনপদ ক্রমে নিবিড় অরণ্যে পরিণত হয়। এই
সময় বিরাট নামক
স্থানে প্রভাবশালী রাজার প্রাসাদ
ছিল। এখনে যে সকল ইটের স্ত্তপ দেখা যায়
সেটি দেখে মনে হয়
রাজধানীটি চতূর্দিকে একেবার
ক্ষূদ্রপরিখা বেষ্টিত হবার পর
আরেকটি বৃহৎ পরিখা বেষ্টিত ছিল
এবং নগরীর মধ্যে ছিল অনেক ভলো ছোট বড়
জলাশয়। রাজা বিরাট প্রসংগে মোশাররফ
হোসেন প্রণীত ‘দিনাজপুরের ইতিহাস’
গ্রন্থের ১০ পৃষ্টায় ঐতিহাসিক বুকাননের
উদ্বৃতি দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘১৮০৭
সালে করতোয়া নদী রাজা ভগদত্ত
এবং বিরাট রাজার রাজ্যের অভিন্ন
সীমানায় ছিল। মহাভারতের
বর্ণনা অনুযায়ী রাজা ভগদত্ত কমরুপের
রাজা ছিলেন। সেই সময় বিরাট রাজার
দেশ মৎস্যদেশ নামে পরিচিত ছিল।
নদীসমুহ মৎস্যবহুল হওয়ার জন্য এই নামকরণ
করা হয়েছিল বলে ধারনা করা যায়।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বিরাট
রাজা পান্ডবদেরপক্ষ অবলম্বন করেন
এবং পুত্রসহ নিহত হন। ‘‘ হিন্দু পঞ্জিকা’’
মতে খৃষ্টপুর্ব ৩২০০ অব্দে এই যুদ্ধ সংঘঠিত
হয়। মহাভারতের বর্ণনানুসারে জানা যায়
এই যুদ্ধের পুর্বে মৎস্যদেশের
সাথে পান্ডবদের যোগযোগ ছিল।
উল্লিখিত তথ্য গাইবান্ধার
রাজা বিরাটের প্রাচীনত্ব
এবং মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ
এবং পঞ্চ পান্ডবদের এখানে অবস্থানের
পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে। এছাড়া ১২৬৮
সালে প্রকাশিত কালীকমলা শর্মা রচিত
‘‘বগুড়া মেতীহাস বৃত্তান্ত’’ নামক গ্রন্থের
৪র্থ অধ্যায়ে মহা ভারতের সেই মৎস্যদেশ
সম্পর্কে উল্লেখ আছে ‘‘ মৎস্যদেশের
নামের পরিবর্তন লইয়া এই ক্ষণে এই
স্থানে জেলা সংস্থাপিত হইয়াছে। উত্তর
সীমা রংপুর জেলা, দক্ষিণ-পুর্ব
সীমা দিনাজপুর জেলা। বগুড়া হইতে ১৮
ক্রোশ অন্তর ঘোড়াঘাট থানার দক্ষিণে ৩
ক্রোশ দুরে ৫/৬ ক্রোশ বিস্তীর্ণ
অতি প্রাচীণ অরণ্যানী মধ্যে বিরাট
রাজার রাজধানী ছিল। তৎপর পুত্র ও
পৌত্রগণ ঐস্থানে রাজ্য করিলে পর ১১৫৩
অবন্দে যে মহাপ্লাবন হয়
তাহাতে বিরাটের বংশ ও
কীর্তি একেবারেই ধ্বংস হইয়া যাওয়ার পর
ক্রমেক্রমে ঐ স্থান মহারণ্য হইয়া উঠিল।
যখন এ দেশের আদ্যপান্ত তাবৎ লোকেই ঐ
স্থাকে বিরাটের
রাজধানী বলিয়া আসিতেছে। আর কীচক ও
ভীমের কীর্তি যখন ঐ স্থানে অনতিদুরেই
আছে আর মৎস্যদেশ যখন বিরাট রাজার
রাজ্য ছিল, ভারতবর্ষ ছাড়া অন্য কোন
স্থানকে মৎস্য দেশ বলেনা তাখন ঐ
স্থানে বিরাট রাজার রাজধানী ছিল তার
অন্যথা প্রমাণ করে না। অতএব
একথা বলা যায় বিরাট এলাকাটি অত্যন্ত
প্রাচীন। এই প্রাচীন এলাকাটি কালীকমল
শর্ম্মার মতে ১১৫৩ অব্দের
মহাপ্লাবনে প্লাবিত
হয়ে নদীগর্ভে তলিয়ে যায় এবং প্রাকৃতিক
কারণে আবার তা নদীতলদেশ
থেকে উত্থিত হয়। তবে রাজা বিরাটের
গোচারণ ভূমির
সাথে গাইবান্ধা নামকরণের সম্পর্ক
যদি নাই থাকবে তবে রাজা বিরাটের এই
কিংবদন্তীটি লোকমুখে এত
ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলোই বা কেন?
যুক্তিহীন বা ভিত্তিহীন কোন বিষয়ের
এত ব্যাপক প্রচার কোনক্রমেই সম্ভব নয়
বলে ধারণা করা যায়।
সুতরাং আমরা বলতে পারি গাই (গরু/
গাভী) বাঁধা থেকে এলাকার নামকরণ
হয়েছে গাইবান্ধা। তবে এই গাইবান্ধার
ব্যাপারটি রাজা বিরাটের
না হয়ে জমিদার ভগদত্তের গোয়ালঘর
বা গো-শালার নামানুসারে এলাকর নাম ‘‘
গাইবান্ধা’’ হয়েছে বলেও মনে করা হয়।